চালের গুণমান অটুট রেখে অধিক হারে ধান উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে ধানের জাতসহ টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সূচনালগ্ন থেকে সৌরভে-গৌরবে অতিবাহিত এ সময়ে এ প্রতিষ্ঠান ৮২টি উচ্চফলনশীল ধানের জাতসহ এমন কিছু সফলতা অর্জন করেছে যা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের আশান্বিত করে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের বিশেষ প্রণোদনা ও যথাযথ তদারকির ফলে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর গতিশীলতা নিশ্চিত হয়েছে।
বিগত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সাত বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্রির অর্জন
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ প্রতিষ্ঠানের ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। এগুলো বরিশাল, ভাঙ্গা, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রংপুর, সাতক্ষীরা ও সোনাগাজীতে অবস্থিত। অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার ধান গবেষণার জন্য বরিশাল, লবণাক্ত এলাকার জন্য সাতক্ষীরা, খরাপ্রবণ এলাকার জন্য রাজশাহী, ঠাণ্ডাপ্রবণ ও জলাবদ্ধ এলাকার জন্য রংপুর, গভীর পানির ধান গবেষণার জন্য হবিগঞ্জ ও ভাঙ্গা, উপকূলীয় এলাকার জন্য সোনাগাজী এবং অনূকূল পরিবেশের জন্য কুমিল্লা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের ১৯টি গবেষণা বিভাগ, ১১টি প্রশাসনিক শাখা ও বিভাগ এবং দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বেশ কিছু টেস্ট সাইট রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রি। বর্তমানে ২৩১ বিজ্ঞানীসহ এর জনবল ৬১৪ জন। একটি পরিচালনা পর্ষদের এর নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম সুসম্পন্ন করেন। এর ভিশন হচ্ছে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ধানের জাতের উন্নয়ন ও ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন। এর মিশনের মধ্যে আছে কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে কম খরচে অধিক ও মানসম্পন্ন ধান উৎপাদনে অবদান রাখা; জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মান সংরক্ষণের মাধ্যমে রোগ, পোকামাকড়, সার, মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; বৈরী পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো ধানের জাত উদ্ভাবন; প্রাগ্রসর গবেষণার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি; দেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যে উদ্ভাবন ও উন্নয়ন ।
আটটি প্রোগ্রাম এরিয়ার মাধ্যমে ব্রির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এগুলো হচ্ছে জাত উন্নয়ন, ফসল-মাটি-পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, ধানভিত্তিক খামার বিন্যাস, আর্থসামাজিক ও নীতি, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং আঞ্চলিক কার্যালয়।
এ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ (বিএডিসি) সাত শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর ১০০ টনের বেশি ব্রিডার বীজ সরবরাহ করে যা পরে আরও বর্ধিত আকারে বীজ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সারাদেশে অনুকূল পরিবেশে বোরো মৌসুমে সর্বাধিক ফলন ও কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয় ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯। আমন মৌসুমে অনুরূপ সফলতার নজির সৃষ্টি করেছে বিআর১১। সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে এ জাতগুলোর পরিপূরক হিসেবে সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮ এবং ব্রি ধান৪৯। পাশাপাশি লবণাক্ত পরিবেশ উপযোগী ধানের জাত ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১ এবং ব্রি ধান৪৭ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ধান উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ জাতগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ব্রি উদ্ভাবিত দুটি ধানের জাত বিআর১৬ এবং বিআর২৫ লো জিআই বা নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স গুণ সম্পন্ন। লো জিআই খাবার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য নিরাপদ। ব্রি ধান৬২ জিঙ্ক সমৃদ্ধ আগাম জাত। মানব দেহের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করবে এ জাত। এ ছাড়াও কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ব্রি উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তির যথাযথ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে।
দেশে দুর্ভিক্ষজনিত মানবিক বিপর্যয় এড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ব্রি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে দেশের ৭ কোটি ১২ লাখ জনসংখ্যার জন্য চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আবাদি জমির পরিমাণ প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমছে। এ সত্ত্বেও দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। চাল উৎপাদনে এ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে প্রধানত ব্রির উচ্চফলনশীল ধানের জাত, আধুনিক চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে। ব্রির কয়েকটি প্রযুক্তি কৃষকদের চাষাবাদ খরচ কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে অবদান রাখছে। এগুলো হচ্ছে-
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এ রকম ধারাবাহিক সফলতার তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার তথা জনগণের তথ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্রির পক্ষ থেকে যেসব কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেগুলোর মধ্যে আছে ধান উৎপাদন প্রযুক্তি তথ্য সংবলিত বইপত্র, লিফলেট, ফোল্ডার, পোস্টার, বার্ষিক প্রতিবেদন, জার্নাল ইত্যাদি প্রকাশ ও বিতরণ; গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা, সংবাদ সম্মেলন, প্রেস ব্রিফিং, গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, ফিল্ড ডে, ফার্মারস স্কুল, প্রশিক্ষণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জরিপ, কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা, গণমাধ্যম ও সম্প্রসারণকর্মীদের সরাসরি অবহিতকরণ এবং সংবাদ প্রচার, নিয়মিত বেতার সম্প্রচারে অংশ নেয়া ইত্যাদি।
*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫